ব্রিটিশ আমলে শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন কমিশন


১)উডের ডেসপাচ--১৮৫৪.
২)হান্টার কমিশন_-১৮৮২

৩)মিত্র কমিশন --- ১৯৯২
৪)স্যাডলার কমিশন-১৯১৭.
৫)হাটর্গ কমিটি-----১৯২৯.(প্রাথমিক শিক্ষা)
৬)নই তালিম----১৯৩৭.(বুনিয়াদি শিক্ষা)
৭)সার্জেন কমিটি-১৯৪৪.
৮)রাধাকৃষ্ণণ কমিশন-১৯৪৮/৪৯. (উচ্চশিক্ষা)
৯)মুদালিয়ার কমিশন-১৯৫২.(মাধ্যমিক)
১০)হংস মেহেতা কমিটি-১৯৬১.(নারিশিক্ষা)
১১)ভক্তবতসলম কমিটি-১৯৬৩.
১২)কোঠারী কোমীশন-১৯৬৪/৬৬(প্রাক প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা)
১৩)জনার্দন কমিটি-১৯৯২

স্যাডলার কমিশন (Sadler Commission)

১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ হবার পর দেশে উচ্চশিক্ষার প্রসার ক্রমশ বৃদ্ধি পায় । উচ্চশিক্ষাকে আরও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বড়লাট চেমসফোর্ডের সময় স্যার মাইকেল স্যাডলারের [Michael Sadler - educationist] সভাপতিত্বে 'স্যাডলার কমিশন' গঠন করা হয় । স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই কমিশনের সদস্য ছিলেন । এই কমিশনের সুপারিশগুলি -

(১) স্কুল শিক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রব্শের আগে দু-বছরের একটি অন্তর্বর্তী পাঠক্রম চালু করা ।

(২) তিন বছরের স্নাতক শিক্ষাক্রম চালু করা ।

(৩) আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ফলিত বিজ্ঞান ও উচ্চ কারিগরি শিক্ষার প্রবর্তন । 

স্যাডলার কমিশনের সুপারিশগুলি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় । ওই বছরই মন্টেগু চেমসফোর্ড আইন দ্বারা শিক্ষা বিভাগকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন থেকে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয় । প্রাদেশিক আইনসভায় নির্বাচিত মন্ত্রী শিক্ষা বিভাগের দায়িত্ব পান । ১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী [Viswa-Bharati] প্রতিষ্ঠা করেন । পাটনা, বারানসী, আলিগড়, আগ্রা, দিল্লি, হায়দারাবাদ, রেঙ্গুন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ধন্দো কেশব কার্ভে পুণায় প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন

বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন

লর্ড কার্জন প্রতিক্রিয়াশীল শাসক হলেও শিক্ষার ব্যাপারে তিনি খুবই উত্সাহী ছিলেন । লর্ড কার্জন স্যার টমাস র‍্যালের সভাপতিত্বে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে 'র‍্যালে কমিশন' গঠন করেছিলেন । এটি 'ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন' [Indian universities Act, 1904] নামেও পরিচিত । স্যার টমাস র‍্যালে ছিলেন বড়লাটের কার্যনির্বাহক সমিতির আইন সদস্য । এই কমিশন গঠনের  উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সংগঠন ও শিক্ষার মান উন্নয়নের ব্যাপারে সুপারিশ করা । কমিশনের দুজন ভারতীয় সদস্য ছিলেন, সৈয়দ হুসেন বিলগ্রামী এবং কোলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি স্যার গুরুদাস বন্দোপাধ্যায় । এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের বিশ্ববিদ্যালয় আইন (Universities Act, -1904) বিধিবদ্ধ হয় । এই আইন বলে ভারতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা হয় । বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সেনেট ও সিন্ডিকেটের সংখ্যা হ্রাস এবং মনোনীত সদস্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় । কলেজগুলি নিয়মিত পরিদর্শন এবং প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি হস্তক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করলেও এই আইনের সাহায্যে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয় পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করেন এবং কলা ও বিজ্ঞান বিভাগে বিষয় বৈচিত্র আনেন ।   

হান্টার কমিশন (Hunter Education Commission)

১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে লর্ড রিপণের সময় উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে হান্টার কমিশন গঠিত হয় । এই কমিশনের কাজ ছিল দেশে ইংরেজি শিক্ষার অগ্রগতি পর্যালোচনা করা ।   শিক্ষার প্রসারে হান্টার কমিশনের ভূমিকা এক অভিনব অধ্যায়ের সূচনা করেছিল । হান্টার কমিশনের সুপারিশগুলি ছিল:-

(১) স্কুল কলেজগুলিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করা ।

(২) বিদ্যালয় ও কলেজগুলিকে সরকারি আর্থিক অনুদান মঞ্জুর করা ।

(৩) সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রাকৃতিক ও ধর্মীয় পাঠ্যক্রম প্রবর্তন করা ।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসারের জন্যও হান্টার কমিশন কতকগুলি সুপারিশ করেছিলেন । যথা—

(১) প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের দায়িত্ব সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত পৌর ও জেলা বোর্ডগুলির হাতে অর্পণ করা ।

(২) সরকারি সাহায্যে প্রতিটি স্কুলে গ্রন্থাগার ও পাঠাগার নির্মাণ করা ।

(৩) মেধাবী ছাত্রদের উত্সাহ ব্যঞ্জক বৃত্তির ব্যবস্থা করা  ইত্যাদি । 

উডের ডেসপ্যাচ (Wood's Despatch of 1854)

:- শিক্ষা সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান করার জন্য ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির পরিচালক সমিতির সভাপতি স্যার চার্লস উড 'শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব' [Wood's Education Despatch] নামে একটি শিক্ষা নীতি রচনা করে ভারতে পাঠান ।  ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে চার্লস উডের সুপারিশ :-

১) শিক্ষার প্রসারের জন্য উডের প্রস্তাব অনুসারে ভারতের প্রতিটি প্রদেশে একজন শিক্ষা অধিকর্তার অধীনে একটি করে শিক্ষাবিভাগ খোলা হয় ।

২) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে প্রেসিডেন্সি শহরগুলিতে অর্থাৎ কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই -এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় । রুরকীর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটিও লর্ড ডালহৌসির আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । 

৩) সরকারি মডেল স্কুলগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি করা ।

৪) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ও নারীশিক্ষার প্রসারের ব্যাপারে জোর দেওয়া । ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের চেষ্টায় স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের জন্য বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ।

৫) প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারেরে জন্য দেশীয় বিদ্যালয়গুলোর উন্নতি সাধন করা এবং

৬) শিক্ষকদের প্রশিক্ষন দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করা ।

৭) বেসরকারি স্কুলগুলিতে সরকারি অনুদান বা গ্র্যান্ট ইন এড প্রথা চালু করা ।  

সরকারি শিক্ষানীতির প্রভাবে ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা লাভের আগ্রহ বৃদ্ধি পায় । ১৮৫৭ সাল থেকে ১৮৮২ সালের মধ্যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৮৩৫ জন স্নাতক এবং ৩৮৫ জন ছাত্র স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে । এতে উত্সাহিত হয়ে সরকার লাহোর ও এলাহাবাদে আরও দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন । 

ব্রিটিশ শিক্ষানীতি (British Education Policy)

ইংরেজ শাসকগণ এদেশে আসার পর প্রথম দিকে এদেশে শিক্ষা বিস্তারে খুব একটা আগ্রহ দেখায় নি । কেবলমাত্র ইংরেজদের রাজ্যশাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করবার জন্য কিছু কিছু ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন করেছিলেন । পরবর্তী সময়ে ইংরেজ শাসককুল ভারতীয়দের মধ্যে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে কিছু কিছু শিক্ষার প্রচার শুরু করেছিলেন । ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুলাই গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়্লেসলির প্রচেষ্টায় কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরী এবং মার্শম্যান নামে দুই খ্রিস্টান মিশনারির প্রচেষ্টায় হুগলির শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় । এই দুটি কলেজে মূলত প্রাচ্যবিদ্যা, বিশেষত বাংলা শিক্ষা দেওয়া হত । ইংল্যান্ড থেকে আগত ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলা ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রধানত এই কলেজ দুটি স্থাপিত হয়েছিল ।  

সরকারি শিক্ষা প্রথা

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রথম সরকারি প্রচেষ্টা শুরু হয় । ওই বছর ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ এক সনদ আইনের মাধ্যমে ভারতে শিক্ষার উন্নতির জন্য বছরে এক লক্ষ টাকা অনুদান মঞ্জুর করেন । দেশীয় ভাষায় বিদ্যালয় স্থাপন এবং প্রাচ্য ভাষা যথা ফরাসী ও সংস্কৃত শিক্ষার পিছনে ওই টাকা ব্যয় করা হবে বলে স্থির হয় । ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ২০ জানুয়ারী রামমোহন রায় ও ডেভিড হেয়ারের প্রচেষ্টায় হিন্দু কলেজ (পরবর্তী কালে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বর্তমানে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি নামে পরিচিত) স্থাপিত হয় । ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ১লা জনুয়ারী লর্ড আমহার্স্টের সময় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাচ্য শিক্ষার প্রসারের জন্য সংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হয় । ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার ডাফের প্রচেষ্টায় জেনারেল অ্যাসেম্বলী ইনষ্টিটিউশন বা স্কটিশ চার্চ কলেজ স্থাপিত হয় । ভারতে ব্রিটিশ শিক্ষানীতি কী হবে এই নিয়ে দুটি গোষ্ঠির উদ্ভব হয় । যাঁরা পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের পক্ষে ছিলেন তাঁদের বলা হত অ্যাংলিসিস্ট । আর যাঁরা প্রাচ্য বিদ্যা প্রবর্তনের পক্ষে ছিলেন তাঁদের বলা হত ওরিয়েন্টালিস্ট । লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে এই বিতর্ক চরমে ওঠে । বেন্টিঙ্ক ইংরাজি শিক্ষার অনুকূলে মত প্রকাশ করেন । ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে মেকলের এক ঘোষণা অনুযায়ী স্থির হয় সরকারি বরাদ্দকৃত অর্থ পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের কাজে ব্যয়িত হবে । এর পরিণামে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের দ্বার উন্মোচিত হয় ও ভারতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নব জীবনের স্পন্দন অনুভূত হয় । ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে জানুয়ারী কোলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে প্রথম চিকিত্সা বিদ্যা পঠন-পাঠনের সূত্রপাত হয় । পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের প্রতি ভারতীয়দের আগ্রহ জন্মায় ।  সরকারি চাকরিতে নিয়োগের নীতি গ্রহণ করায় ভারতীয়গণ বিপুলভাবে এই শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হন । ফলে স্বাভাবিকভাবে দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা, টোল, পাঠশালাগুলির অবস্থা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসে । লর্ড বেন্টিঙ্কের পর লর্ড ডালহৌসিও ভারতে শিক্ষা বিস্তারে আগ্রহী ছিলেন । ফলে তাঁর আমলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে ।

Comments

Popular posts from this blog

কে_কোন_তত্ত্বের_প্রবক্তা

👉 বাংলা সাহিত্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং উত্তর👈

UPSC Political Science Main Solve Paper